টাকা তৈরির ইতিহাস - বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয়
টাকা ছাড়া একটি দিন আপনি কল্পনা করতে পারবেন? আজকের পৃথিবীতে টাকা সবচাইতে আরাধ্য বিষয়। টাকার বিনিময় ছাড়া একটি কাজও সম্ভব কিনা জানা নেই। এই টাকা তৈরির ইতিহাস কী জানা আছে আপনার? বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় সেটা কী জানেন?
চলুন আজ টাকা তৈরির ইতহাস এবং বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হোক।
পোস্ট সূচিপত্রঃ টাকা তৈরির ইতিহাস - বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয়
- টাকা তৈরির ইতিহাস
- টাকা তৈরির নিয়ম
- টাকা তৈরির উপাদান
- টাকা তৈরি হয় কিভাবে
- টাকা তৈরির কারখানা কোথায়
- বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয়
- আমাদের শেষ কথা
টাকা তৈরির ইতিহাস
পৃথীবির জন্মলগ্ন থেকেই টাকার ব্যবহার হয়ে আসছে এমন কিন্তু নয়। সহজ ও সার্বজনীন বিনিময় মাধ্যম তৈরির চিন্তা থেকেই টাকার উৎপত্তি। টাকার ব্যবহার আমরা নিত্যদিনই করে থাকলেও টাকা তৈরির ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আজ জানবো টাকা তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে। সেই সাথে বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় সেটাও জেনে নেবো এক ফাঁকে।
প্রায় ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের ঝাউ রাজবংশের শাসনামলে ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রার প্রচলন হয়। এর আগে অবশ্য কাউরি বা ঝিনুকের খোল দিয়ে মুদ্রা বানানো হতো। এগুলো প্রকৃতিতে খুব সহজলভ্য ছিল বিধায় বিকল্প হিসেবে ব্রোঞ্জে খোদাই করা মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়।
আরও পড়ুনঃ ফেসবুক থেকে আয় করার উপায়
স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যাপকতা লাভ করে ৬৫০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। এ সময় খোদাইকৃত মুদ্রা দিয়ে সেনাবাহিনীর পারিশ্রমিক দেয়া হতো। মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আধুনিক তুরস্কের প্রাচীন রাজ্য লিডিয়ায়। ইলেক্ট্রাম নামে পরিচিত রূপা ও সোনার একটি সংকর ধাতু ব্যবহার করা হতো মুদ্রাটি তৈরি করতে।ধাতুর তৈরি মুদ্রার কথা তো জানলাম,কিন্তু কাগজের টাকা তৈরীর ইতিহাস কী জানবো এবার।
কাগজের মুদ্রা সর্বপ্রথম তৈরি করা হয় ৭০০ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দে চীনে। তৎকালিন চীনে কাগুজে মুদ্রা তৈরির কারখানাও ছিল। এই মুদ্রা বেশি দিন লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিরাজ করতে পারেনি। ১৪৫৫ সালের পরেই বন্ধ হয়ে যায় এই টাকার ব্যবহার। ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চীন আবার তার ধাতব মুদ্রায় ফিরে যায় এবং পরবর্তীতে আবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মুদ্রা।
বাংলাদেশের বাংলা টাকা তৈরির ইতিহাসও কিন্তু বেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় তাও আমরা জানবো এর উৎপত্তি হয়েছে ১৪ শতাব্দীতে। ইউরোপ থেকে এশিয়ার বাণিজ্য পথ বিখ্যাত সিল্ক রোডের লেনদেনকৃত এক প্রসিদ্ধ মুদ্রা ছিল এই টাকা। শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ট্যাঙ্কহ থেকে।
আরও পড়ুনঃ বৃষ্টি কেন হয় | এসিড বৃষ্টি কেন হয়
সুলতানি টাঙ্কা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ১৩২৯ সালে দিল্লি সালতানাতের সম্রাট মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সময়। চীনের মঙ্গোল এবং পারস্যদের মুদ্রার আদলে তৈরি করা এই টাঙ্কা ব্যবহৃত হতো প্রতিনিধিত্বমূলক মুদ্রা হিসেবে। তামা ও পিতলের তৈরি এই মুদ্রার মূল্য সাম্রাজ্যের কোষাগারে স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুদের সঙ্গে বিনিময় করা হতো। তুঘলগ রাজবংশের পতনের অনেক পরেও মুঘল সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে কিছু অঞ্চলে প্রচলিত ছিল টাঙ্কা। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৮ সালে রৌপ্য টাকার জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করেছিলেন। বাংলার সুলতানদের জন্য এই মুদ্রা ছিল সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি রুপিতে উর্দু এবং বাংলায় দুভাষারই শিলালিপি ছিল এবং একে রুপি ও টাকা উভয় নামেই ডাকা হতো। এটি ছিল বাংলা টাকার প্রথম কাগুজে সংস্করণ।
টাকা তৈরির নিয়ম
টাকা আমাদের পুরো পৃথিবী টিকিয়ে রাখার প্রাণভোমরা হিসেবে রয়েছে,টাকা নিয়ে কৌতুহল তাই কম নয়। টাকা তৈরির ইতিহাস জানলাম, টাকা তৈরির নিয়ম কী জানা আছে আমাদের সবার? টাকা তৈরির নিয়ম জানলে কিন্তু অবাকই হবেন। বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় এই প্রশ্নও নিশ্চয়ই ঘুরপাক খায় মনে?সমস্ত কিছুর উত্তর মিলবে আজ।চাইলেই ইচ্ছেমতো টাকা তৈরি করা যায় কিনা, এক্ষেত্রে টাকা তৈরি নিয়ম টা কি?!
চলুন টাকা তৈরির ইতিহাসের সাথে টাকা তৈরীর নিয়ম টাও জেনে নেয়া যাক।
টাকা তৈরি করার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই টাকা তৈরি করতে হয়। প্রতিটি দেশে মোট যেই পরিমাণে জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ঠিক সেই পরিমাণে টাকা ছাপানো হয়। এই নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিটি দেশকেই মেনে চলতে হয়।
আরও পড়ুনঃ কোটিপতি হওয়ার ইসলামিক উপায়
তবে কোনো দেশ চাইলেই নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা ছাপাতে পারে।এমন কোনো বিধিনিষেধ বা ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যে এতো টাকা ছাপানো যাবে বা এর বাইরে ছাপানো যাবেনা।
তবে পুরো বিষয়টি নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে যা জীবনযাত্রা খরচ বাড়িয়ে দেবে। তাই একটি ভারসাম্য রাখতে হয় অর্থনীতির স্বার্থেই।অতিরিক্ত টাকা তৈরি করলে মুদ্রাস্ফীতি এতটাই বেড়ে যাবে যে তখন সামন্য জিনিস কিনতে থলে ভর্তি টাকা নিতে হবে
টাকা তৈরির উপাদান
টাকা একটা কাগজ মোটে অথচ পুরো পৃথিবী চালাচ্ছে এই কাগজ,কী অদ্ভুত! টাকা তৈরির উপাদান কী শুধুই কাগজ? নাকি টাকা তৈরির
উপাদান হিসেবে অন্য কিছুও ব্যবহার করা হয়? কী কী জিনিস টাকা তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় চলুন জেনে নেই।
সবদেশের প্রায় সব ব্যাংকনোট তুলার তৈরি কাগজ থেকে তৈরি হয়, যার ওজন প্রতি বর্গমিটার ৮০-৯০ গ্রাম। তুলার সেই কাগজে কখনো কখনো লিনেন যুক্ত করা যায়। এই কাগজগুলো প্রায় ২ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ কাগজে জিলাটিন বা পলিভিনাল অ্যালকোহল যোগ করা হয় বলে বেশ টেকসই।বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর বিশেষ কাগজ আসে সুইজারল্যান্ড থেকে।
টাকা তৈরি হয় কিভাবে
ইশ! টাকা তৈরি করার মেশিন যদি একটা থাকতো সেই মেশিনে টাকা কিভাবে তৈরি হয় যদি জানতাম! এমন কথা মনে আসেনি তেমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। টাকা তৈরি করার মেশিন হয়তো আমারা পাবো না কোনোদিনই।
টাকা তৈরি হয় কিভাবে সেটা নিয়েও আমাদের আগ্রহের শেষ নেই।বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় কিভাবে তৈরি হয় সেটাও কিন্তু বিরাট প্রশ্ন।টাকা তৈরির ইতিহাস জেনেছি, টাকা তৈরি হয় কিভাবে চলুন জানা যাক।
সাধারণ কাগজ তৈরি হয় সেলুলোজ(cellulose) দিয়ে। কিন্তু সব ব্যাংকনোট তুলার (cotton) তৈরি এক বিশেষ কাগজে ছাপানো হয়।যার ওজন প্রতি বর্গ মিটারে ৮০-৯০ গ্রাম।তুলা, উন্নতমানের কাগজ,প্রয়োজনীয় উপকরণের মিশ্রণ মেশিনে উচ্চ চাপের সাহায্যে শিট কাগজে রুপান্তর করা হয় এবং নির্দিষ্ট মাপে জলছাপ দেওয়া হয়।
যা বিশ্বের সকল নোটের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এরপর অপর একটি মেশিনে হলোগ্রাম বা সূতা লাগানো হয়। কম্পিউটার অপারেটিং একটা মেশিনে দিয়ে পর্যাপ্ত চাপের সাহায্যে সূতা ভালো ভাবে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর টাকার আদর্শ আদলে কাগজ কাটা হয়, রং করা হয়,শুকানো হয়, প্রিন্টিং মেশিনে দিয়ে টাকার ওপর বিভিন্ন লেখা ছাপানো হয়।টাকার কাগজ বেশ টেকসই হয়ে থাকে।এতে লিলেন,জিলাটিন বা পলিভিনাল আ্যালকোহল যোগ করা হয়।
টাকা তৈরির কারখানা কোথায়
টাকা তৈরির ইতিহাস জেনেছি,টাকা কিভাবে তৈরি হয় তাও নাহয় জানলাম। কিন্তু টাকা তৈরির কারখানা কোথায় এমন প্রশ্ন জাগেনি কখনো মনে? বহুল আরাধ্য যে টাকা,সেই টাকা তৈরির কারখান কোথায় রয়েছে জেনে নেবো।
টাকা তৈরির কারখানা টাঁকশাল নামেই পরিচিত। অফিশিয়াল নাম অবশ্য দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড। দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাঁকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে।
বিশ্বে ২০০ টি স্বাধীন দেশ অথচ সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে নোট মুদ্রণের ছাপাখানা আছে মাত্র ৬৫ টি, যার মধ্যে বাংলাদেশের টাঁকশাল একটি।
বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয়
বাংলাদেশে টাকা তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি, কিন্তু বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় সেটা বোধহয় আমরা জানি না। বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয় জেনে নেবো।
দেশের টাকা ছাপানোর একমাত্র প্রতিষ্ঠানের অবস্থান গাজীপুরে। টাকা ছাপালেও বাংলাদেশের টাঁকশালে কোনো কয়েন তৈরি হয় না। আর্থিকভাবে লাভ লোকসান বিশ্লেষণে দেশের জন্য কয়েন উৎপাদন লাভজনক বিবেচিত না হওয়ায় আমাদের টাঁকশালে এখনো কয়েন তৈরির কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি এবং এ জন্য কয়েন তৈরির কোনো মেশিনও সংস্থাপন করা হয়নি।
তবে টাঁকশালে শুধু যে টাকাই ছাপা হয়, ব্যাপারটা এমন নয়। টাকা ছাপানোর উদ্দেশ্যে স্থাপিত হলেও সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রী এখানে ছাপানো হয়।যেমন-অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সঞ্চয়পত্র, নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রাজস্ব স্ট্যাম্প, আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক সামগ্রী ইত্যাদি
প্রায় ৬৬ একর জায়গা নিয়ে অবস্থান করছে দেশের টাকা তৈরির একমাত্র এই কারখানা।গাছগাছালিতে ভরা কারখানাটির বহু স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মী ও প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। পুলিশের প্রায় ৮০ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে।
মুদ্রণসহ যেকোনো নিরাপত্তাসামগ্রী উৎপাদনে বেশ কিছু পর্যায়ে বিভিন্ন ঘরে কাজ করা হয়ে থাকে। নির্ধারিত কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছাড়া এক হল থেকে অন্য হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারেন না। প্রতিটি হলের জন্য আলাদা এন্ট্রি পাস ছাড়াও দরজায় নিরাপত্তাকর্মীরা অন্যদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আমাদের শেষ কথাঃ টাকা তৈরির ইতিহাস - বাংলাদেশের টাকা কোথায় তৈরি হয়
টাকা তৈরি সম্পূর্ণ গোপনীয় একটি প্রক্রিয়া, তাই এটি নিয়ে প্রচুর ধোঁয়াশা রয়েই যায়। টাকা তৈরির ইতিহাস সম্পর্কে জানা গেলেও টাকা তৈরি প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ ভাবে জানার উপায় থাকে না। টাকার প্রতি লোভ জাল নোট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে আসল এবং নকল টাকা সম্পর্কে তাই সচেতন থাকার আহবান থাকলো সবার প্রতি
fasttechit নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url